আবার এই বাজারের পুরোনো ব্যবসায়ীরা জানান, বুড়িগঙ্গা নদীপথকে কেন্দ্র করে ঢাকার মোগল আমলের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছিল, তার পুরোটাই ছিল মৌলভীবাজার ও চকবাজারকেন্দ্রিক। এই দুই বাজার থেকে ঢাকা শহরের বাজারগুলোতে তো বটেই, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, মসলা, গুঁড়ো দুধ, প্রসাধনী, খেলনা, ইমিটেশন গয়নাসহ নানা পণ্য পাইকারি সরবরাহ করা হয়। ব্রিটিশদের পরে পাকিস্তান আমল গেছে। এরই মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশও ৫০ বছর পেরিয়েছে। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এখনো দেশের অন্যতম শীর্ষ পাইকারি ব্যবসার কেন্দ্র রয়ে গেছে। কয়েক পুরুষ ধরে এখানে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। সরেজমিনে গত বুধবার প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা, সমস্যা, সম্ভাবনা জানতে যান। আলাপকালে জানা যায়, মৌলভীবাজার ও চকবাজারে সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ কসমেটিকসের, ১২ শতাংশ বিভিন্ন মসলার, ১০ শতাংশ মুদিপণ্যের, ৫ শতাংশ তেল-চিনি বিক্রি করে। বাকি ৩৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক, সিনথেটিক, বেকারিসহ অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই বাজারে কয়েক শ আমদানিকারক রয়েছেন, যাঁরা বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করেন।
এখানে তেল-চিনির ব্যবসায়ী সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে তাঁদের পণ্য বিক্রির পরিমাণ অনেক বেশি। তেল-চিনির বিক্রির অনেক প্রতিষ্ঠানই মাসে কয়েক শ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে থাকে। এরপর আছে আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন মুদিপণ্য, মসলা, বেকারি, কসমেটিকস ও অন্যান্য পণ্য। জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন বলেন, আগে একসময় এখানে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হতো। তখন এই এলাকার বাসিন্দারা পুরোনো ভবনের সামনে বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসতেন। এখন অনেক ভবন আর নেই। কারণ, সময়ের সঙ্গে ব্যবসা বেড়েছে। তবে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা যেভাবে সরকারকে রাজস্ব দেন, সেভাবে এখানে উন্নয়নকাজ হয়নি। এখনো সেই গলিপথই রয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, আগে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তানেরা বংশপরম্পরায় সবাই ব্যবসা করতে চাইলেও নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন আর ব্যবসায়ে থাকতে চাইছেন না। তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উচ্চশিক্ষায় আকৃষ্ট হচ্ছেন। এবং দেশে সরকারি–বেসরকারি চাকরিসহ নানা পেশায় যোগ দিচ্ছেন, কিংবা আরও উচ্চতর শিক্ষা নিতে বা চাকরি করতে বিদেশবিভুঁইয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন। মূলত দেশে শিক্ষাবিস্তারের প্রভাবে এই পরিবর্তন ঘটেছে।
মো. বশির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা এখানে ব্যবসা করেছেন। তাঁদের হাত ধরে আমার বড় ভাই, যিনি মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তিনি ব্যবসায়ে আসলেন। আমিও আসলাম। কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম এই ব্যবসা ধরে রাখতে অত আগ্রহী না। তারা ব্যবসা করার চেয়ে পড়াশোনা করে চাকরিবাকরিতে যোগ দেওয়াকেই বেশি সম্মানের মনে করে। তবে আমাদের কাছে ব্যবসাই বেশি সম্মানের।’ অনেকটা তাঁর সুরেই কথা বললেন মসলা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মৌলভীবাজারের আদি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই এখন আর ব্যবসায়ে যুক্ত নেই। বাকিদের মধ্যে যাঁদের উত্তরসূরি ব্যবসায়ে আছেন, তাঁরাও বেশির ভাগ ভালো অবস্থায় নেই। অন্যদিকে, এ এলাকায় বিভিন্ন সময়ে যাঁরা কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন, তাঁরাই এখন বড় ব্যবসায়ী। দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছেন।
দিনে হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা
মৌলভীবাজারে বেচাকেনার সঠিক হিসাব পাওয়া বেশ জটিল। অনেকেই বেচাকেনার পরিমাণ নিয়ে কথা বলতে চান না। তবে ক্রেতা-বিক্রেতা, ফড়িয়া, ভবনমালিক ও ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে, সেটি এ রকম—এখানে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা হয়। এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির দপ্তর সম্পাদক হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌলভীবাজারে অনেক আমদানিকারক রয়েছেন এবং ভোগ্যপণ্যের বড় বড় ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানও আছে। তাই এখানে প্রতিদিন যে বেচাকেনা হয়, তা গড়ে হাজার কোটি টাকার নিচে নয়।’ তিনি আরও বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটে এখানকার বেচাকেনা বেশ কমেছে। এ এলাকায় দেশের প্রায় সব ব্যাংকের শাখা আছে। যেসব ব্যাংক খোদ মৌলভীবাজারে জায়গা পায়নি, তারা আশপাশের চকবাজার, বেগমবাজার, জেল রোড কিংবা মিটফোর্ড এলাকায় শাখা খুলে ব্যবসা করছে। বড় ব্যাংকগুলোর প্রতিটি শাখায় বর্তমানে দৈনিক ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়। এই লেনদেন বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের আগে আরও বেশি ছিল। ঋণপত্র (এলসি) খোলার জটিলতায় আমদানি ব্যবসা অনেক ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আর মিল থেকে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ–ঘাটতির কারণেও ট্রেডিং ব্যবসায়ে টানাটানি চলছে। এখানে এজেন্ট ব্যাংক, বিমা, সমবায় সমিতি ও স্থানীয় বিভিন্ন সমিতি মিলিয়ে শতাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে ব্যবসার রূপান্তর
পুরোনো ব্যবসায়ীরা জানান, আগে মৌলভীবাজারে শুধু ভোগ্যপণ্যই পাওয়া যেত। স্বাধীনতার পরে সত্তরের দশক থেকে এখানে নতুন করে প্রসাধনী, খেলনা, প্লাস্টিকজাত পণ্য, ইমিটেশন গয়নাসহ বিভিন্ন ব্যবসা যোগ হয়। সেটা চকবাজার, বেগমবাজারসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রসাধনীর ব্যবসা। আগে প্রসাধনী শুধু আমদানি হতো। এখন দেশে তৈরি পণ্যও পাওয়া যায় মৌলভীবাজারে। আলাপকালে জানা যায়, মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ে বিশ্বাসের রূপান্তর ঘটেছে কম। মালিকপক্ষ দেখভাল করলেও আজও ব্যবসা পরিচালনার বড় অংশীদার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁদের মধ্যে টাকা মেরে খাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। দুই–একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যে ঘটে না, এমন না। তবে এখানে যে পরিমাণে টাকা হাতবদল হয়, সেই অনুপাতে সেটা কম। ব্যবসায়ীরা বলেন, মৌলভীবাজারে বাকিতেও প্রচুর পণ্য বিক্রি হয়। তবে লেনদেনের বড় অংশই হয় নগদে। সেই টাকা দিনে দিনেই ব্যাংকে জমা হয়। কর্মীদের মাধ্যমেই লেনদেন হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা ব্যাগে ভর্তি করে কর্মচারীদের মাধ্যমে ব্যাংকে পাঠান। নগদ লেনদেনের সময় চুরি–ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন একেবারে নেই বললেই চলে। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিও নেই।
ব্যবসায়ীরা জানান, মৌলভীবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য নিতে এখনো ভরসা নৌপথ। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকা থেকে পণ্য নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এখনো ট্রাকের বদলে নৌপথের ওপর ভরসা রাখেন। নোয়াখালীর হাতিয়ার হাজি হেলাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী দিদারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকা, চট্টগ্রাম উভয় শহরের পাইকারি বাজার থেকে পণ্য নিই। তবে চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকা থেকে পণ্য নেওয়া সহজ। লঞ্চে ওঠাই দিতে পারলে দিনের পণ্য দিনেই পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ব্যবসায়ীর মালামাল ঘাটে এসে পৌঁছাল। তখন ঘাট থেকে সরাসরি পণ্য কিনে পরিবহন করা আরও সহজ হয়।’