নারী-শক্তির উত্থান: অল-উইমেন অফিস
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ এ ১২:২১ PM
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীচালিত কর্মসংস্থান এর একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই অফিস গুলো সম্পূর্ণভাবে নারী কর্মী দ্বারা পরিচালিত এবং সমাজের বহু পুরোনো পরাধীনতার শেকল ভেঙে নারীর নেতৃত্বের পদে আসীন হওয়ার একটি সহায়ক হিসেবে দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু দুখঃজনক হলেও সত্যি, নারীর স্বাধীনতা নিয়ে এত জলঘোলা হবার পরেও আমাকে মহিলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি অফিস পরিচালনা করতে বহু কাঠ-খর পোড়াতে হচ্ছে। কেউ না কেউ কোনো না কোনোভাবে আমাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। যখন আমি প্রথম বারের মত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবেছিলাম, আমি ঠিক করেছি সর্ব-নারী চালিত অফিস তৈরী করবো। প্রত্যেকটি নারীকে নিয়োগ করা সহজ ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কঠিন কাজটি ছিলো একজন অফিস সহায়তাকারী মহিলা সাপোর্ট-স্টাফ নিয়োগ করা যিনি ভ্যাট অফিস বা ব্যাংক এর মত পুরুষশাসিত জায়গায় যেতে অনীহা পোষণ করবেন না। এই সমস্যাটি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল। তবে আমরা অনেকাংশে এর সমাধান করে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। অনেক কারণেই মহিলারা ঘরের বাইরে কাজ করতে নিরাপদ বোধ করেননা। এর মধ্যে কিছু কারণ হচ্ছে যৌন হয়রানি, লিঙ্গ বৈষম্য এবং বাংলার গৎবাঁধা কিছু ছাইপাশ নিয়ম-কানুনে্র জন্য। অফিসে সহিংসতার ঝুঁকি এবং কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার লক্ষ্যবস্তু হবার ভয় ও কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ। কর্মস্থানে পরিমিত আলোর অনুপস্থিতি, সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এর অভাব এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সামাজিক নিয়মকানুন এবং লিঙ্গ বৈষম্যতা নারীর জন্য প্রতিকূল পরি শ তৈরি করে তোলে এবং তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সম্পূর্ন নারীচালিত অফিসের একটি সুবিধাজনক দিক হলো একটি সহযোগিতামূলক কাজের পরিবেশ তৈরি করতে পারা। গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা পুরুষদের তুলনায় ভালো শ্রোতা। আমরা নারীরা প্রায়ই পুরুষদের তুলনায় বেশি যোগাযোগপ্রবণ এবং সহানুভূতিশীল যা দলগত কাজের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ভুমিকা পালন করে এবং যে কোনো সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে। এছাড়াও, প্রত্যেক নারী ব্যাক্তিগত জীবনে কিংবা কর্মক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতায় অনন্য। সর্ব-মহিলা অফিসের আরেকটি সুবিধা হলো যে তারা অন্যান্য সহকর্মীদের মাঝে একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং বন্ধুত্বের জায়গা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এই ব্যাপারটি Pursuit Education কে সহায়তা করেছে। কারণ এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা এবং সমস্যার কথা প্রকাশে এবং পরামর্শ গ্রহণে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে যা তাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সামনে অগ্রসর হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ৫ জন মহিলার একটি টিম নিয়ে গত বছর নভেম্বর মাসে Pursuit Education যাত্রা শুরু করে। এটি একটি স্টুডেন্ড প্লেইসমেন্ট এবং ল্যাংগুয়েজ লার্নিং সেন্টার। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোর্স থেকে শুরু করে IELTS, PTE কোর্স এবং ছাত্রদের কাউন্সেলিং ও ভিসা প্রসেস থেকে টিকেট ক্রয় পর্যন্ত, আমাদের ব্যবসার প্রতিটি সেক্টর নারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই ব্যবসা শুরু করার আগে আমি নয় বছর শিক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।এই বিভাগে কাজ করার সময় আমি বেশ কিছু অসাধারণ মহিলা এবং পুরুষ পরামর্শদাতাদের সান্নিধ্য লাভ করেছি, কিন্তু আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনুভব করেছি যে নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি সহানুভূতির প্রকাশ করতে পারেন।যখন পিতামাতারা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠানোর পরিকল্পনা করেন, নিঃসন্দেহে এটি তাদের জন্য অনেক বড় একটি সিদ্ধান্ত। আমি Pursuit Education এর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চেয়েছি যেন আমাদের কাছে পেশাদার বিশেষজ্ঞদের দলের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের জন্য একটি উজ্জ্বল এবং ফলপ্রসূ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারি। আমরা চেষ্টা করছি যেন শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে আমাদের পূর্ণাঙ্গ সেবা এবং ফ্রী কাউন্সেলিং সেশন এ যুক্ত হতে পারে। আমরা প্রয়োজনভেদে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বিশেষ মনোযোগের সাথে সেবা প্রদানে বিশ্বাসী। এর মানে কি এটা দাঁড়াচ্ছে যে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষার্থী পাচ্ছিনা? অবশ্যই, হতে পারে আমরা তুলনামূলক কম শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের সেবা পৌছাতে পারছি।কিন্তু আমরা নামমাত্র কিছু সংখ্যার বদলে মানসম্মত সেবায় বিশ্বাসী। যাই হোক, একটি সম্পূর্ণ নারী চালিত অফিসে কিছু সম্ভাব্য ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের অফিসে আসা অনেক পুরুষ গার্ডিয়ান মনে করেন যে আমরা লিঙ্গ বৈষম্যকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করি এবং কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতাকে সীমিত করি। আমাকে এই কথাও শুনতে হয়েছে যে তাদের ছেলেদের জন্য শুধুমাত্র পুরুষ কাউন্সেলর সরবরাহ করতে হবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, আমরা অনুরোধ করেছি মহিলা কাউন্সেলর এর সাথে কাজ করতে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা যেনো প্রয়োজনে তাদের মাকে সাথে নিয়ে আসেন। কিন্তু আমরা আমাদের উপায় পরিবর্তন করিনি। সৌভাগ্যক্রমে, আমরা এই পরিবার গুলোর সাথে কাজ করতে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমরা দেখেছি যে সমস্ত মহিলা অফিসগুলি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আমি নিজেকে একজন দক্ষ দলনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অন্যান্য নারীচালিত অফিস নিয়ে রিসার্চ করেছি। আমি লক্ষ করেছি Bustle নামে একটি ডিজিটাল কোম্পানি এর সম্পাদকীয় দলের সবাই নারী। প্রতিষ্ঠানটি এর অনন্য অবদানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করছে প্রধানত নারীগোষ্ঠীকে। একইভাবে, স্টার্টআপ MM. Lafleur-এর একটি সর্ব-মহিলা নেতৃত্বের টিম রয়েছে। এই টিমটি কোম্পানিটিকে এমন একটি ব্র্যান্ড তৈরি করতে সাহায্য করেছে যা পেশাদার মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। এই ব্যাপারটি আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সম্পূর্ণভাবে মহিলাদের জন্য একটি কর্মসংস্থান তৈরী করার পেছনে। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাও বিশ্বাস করি যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে চাকরিক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। যেহেতু আমি নিজেকে একজন নারীবাদী বলে দাবি করি, নারীশক্তির উত্থানে অংশগ্রহণ করা আমার দায়িত্ব। কিন্তু আমি পুরুষদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত করতে সম্মত নই। নারীবাদ মানে পুরুষবিদ্বেষী হওয়া নয়। অথচ প্রায়ই আমরা এই দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার কে এক করে ফেলি। আমাদের উচিত নারী উদ্যোক্তাদের সমর্থন করা, নারী লেখকদের বই পড়া, রাজনীতিতে নারীদেরকে আরও কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা এবং নারীদের অলাভজনক সংস্থাগুলিকে সমর্থনে এগিয়ে আসা। আমরা যদি নারীদের জন্য সত্যিকার অর্থেই পরিবর্তন আনতে চাই তবে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এভাবেই আমরা আমাদের সমাজকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারবো সমৃদ্ধির দিকে। পারিবারিক কলহ, নারী ক্ষমতায়ন এবং যৌন নিপীড়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা কেবল নারী দিবসেই সীমিত হওয়া উচিত নয়। আসুন এটিকে শুধুমাত্র একটি আধুনিক ট্রেন্ড বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কনটেন্ট এর আওতাভুক্ত না করি। আমি সকল পুরুষদেরকে আহ্বান করছি আমাদেরকে শুনুন, জানুন এবং এই বহু পুরোনো সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসুন। এবং সকল নারীদের কাছে অনুরোধ দয়া করে নিজেদেরকে কারোর কাছে বিলীন করে দেবেন না। চলুন আমরা সকল নারীরা একসাথে সামনে এগিয়ে যাই। আজকে সকল নারীরাই পুরুষদের মত কর্মসংস্থানের সুযোগ খোঁজে। এটি তাদের পরিবারের জন্য আয় বাড়াতে সহায়তা করে এবং তাদের পছন্দের ক্যারিয়ার খুঁজে পেতে সাহায্য করে। তাদের প্রতিভা বিকাশ করার সুযোগ দেয়। কিন্তু এটি তাদের পরিবারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।যেমন চাকরিজীবি নারীরা সন্তানদের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে পারেনা। এমনকি মা হিসেবে একজন নারীর ভূমিকা কর্মক্ষেত্রে আমার কাজকেও প্রভাবিত করে থাকে। এ সত্ত্বেও কর্মজীবনে নারীদের অবদান এবং সফলতা অনস্বীকার্য । সামগ্রিকভাবে, একটি সম্পূর্ণ নারী-চালিত অফিস লিঙ্গ সমতা প্রচারের লক্ষে এবং একটি সহযোগিতামূলক কাজের পরিবেশ তৈরির করার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। যদিও এটি প্রতিটি কোম্পানির জন্য সঠিক পছন্দ নাও হতে পারে।কিন্তু আমার মতে যেসব প্রতিষ্ঠান এই সাহসী পদক্ষেপটি নিতে পেরেছে তারা দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মোচন করতে পেরেছে। নুর-এ-তাজরিয়ান খান ম্যানেজিং ডিরেক্টর, পারস্যুট এডুকেশন
মন্তব্য( ০ মন্তব্য)