বাংলাদেশে গ্যাস পুড়িয়ে রান্নার সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠী মূলত শহরাঞ্চলের। কিন্তু সেখানেও চরম বৈষম্যমূলক নীতি চালু রাখা হয়েছে। কোনোরকমে এক বেলা ভাত আর একটা তরকারি রান্নার সামর্থ্য যে পরিবারের আছে আর যে পরিবারে সারা দিন গ্যাস পুড়িয়ে রান্না চলে, দুজনকেই মাস শেষে সমান বিল শোধ করতে হয়। ঢাকার ক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্যাস–সংযোগ থাকলেও দিনে অধিকাংশ সময় গ্যাস পাওয়া যায় না, এমন যেসব এলাকা, সেগুলোতে সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের বাস। তাঁদের অনেককেই বাধ্য করা হচ্ছে গ্যাসের বিল দেওয়ার পরও সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে। বস্তিতে কিংবা ঢাকার উপকণ্ঠগুলোয় নিম্ন আয়ের মানুষেরা থাকেন। এসব এলাকায় সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। রান্নার জন্যই পরিবারগুলোর আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। আবার স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী হওয়ায়, সারা দিন চুলা জ্বলে না, এমন পরিবারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। অথচ মাস শেষে তাঁদের ঠিকই নির্ধারিত বিল পরিশোধ করতে হয়।করোনা–পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় জ্বালানি এখন সোনার হরিণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ–সংকটে চাইলেও চাহিদামতো গ্যাস আমদানি করতে পারছে না সরকার। গ্যাস–সংকটে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে শিল্প। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। উদ্বেগ ও শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে। এ রকমটা বেশি দিন ধরে চলতে থাকলে অর্থনীতিতে মন্দা আসার শঙ্কা তাঁদের। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারাবেন। ব্যবসায়ী নেতারা দফায় দফায় সরকারের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তাঁরা বলছেন, প্রয়োজনে তাঁরা বেশি দাম দেবেন, তবু যেন সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে আনে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আরেকটি দাবি এসেছে, বাসাবাড়ি ও সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে দেওয়ার জন্য।
বাসাবাড়ি থেকে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে দিতে গেলে ঘরে ঘরে যে অসন্তোষ তৈরি হবে, তার অভিঘাত রাজনৈতিক বিপ্লবের চেয়ে কম বড় নয়। ব্যবসায়ীরা যতই বলুন, সরকার এখন সে পথে যাবে না। কিন্তু বাসাবাড়িতে রান্নার জন্য ব্যবহৃত গ্যাসে যে অসমতার সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুতের মতো গ্যাসেও কেন মিটার ব্যবহার করা হয় না? যিনি যতটুকু গ্যাস পোড়াবেন, তার চেয়ে বেশি অথবা কম বিল কেন তিনি শোধ করবেন?
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি শিল্পোদ্যোক্তা এ কে আজাদ বলেছেন, ‘জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান কম নয়। শিল্প খাতকে সবল করতে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিলে তার সুবিধা দেশের সব মানুষই পাবে। রাতারাতি আমরা গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে পারব না। সে ক্ষেত্রে সরকার দুটো কাজ করতে পারে—সিএনজি স্টেশনগুলোতে যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, তা শিল্পকারখানায় ডাইভার্ট করতে পারে। আরেকটি হলো বাসাবাড়িতে বর্তমানে ১৩ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যা জাতীয় অর্থনীতি কিংবা কর্মসংস্থানে কোনো ভূমিকা রাখছে না। এই সংকটকালে সরকার বাসাবাড়ি ও সিএনজি স্টেশনের গ্যাসশিল্প খাতে নিয়ে সরিয়ে নিলে শিল্পকারখানাগুলো রক্ষা পেতে পারে। এমনকি ৫ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পারলেও কারখানাগুলো চালু রাখা যায়।’ গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থায় সিস্টেম লসের নামে যে বিপুল পরিমাণ চুরি হয়, তা বন্ধ করা গেলেই এই ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব। পেট্রোবাংলার তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিস্টেম লস বেড়েছে পাঁচ গুণ। পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে উৎপাদিত ও বিক্রীত গ্যাসের সিস্টেম লস ছিল দেড় শতাংশ। পরে সেটা বেড়ে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। (বণিক বার্তা, ১০ নভেম্বর ২০২২)
আরও পড়ুন
সংকটে বিদ্যুৎ সাশ্রয়: জাপানিরা পারে, আমরা পারি না কেন
গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছুটা কারিগরি অপচয় হলেও সরবরাহব্যবস্থায় সেটা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে চুরির পুরোটাই সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত নষ্ট হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই গ্যাস আসলে কোথায় যায়? শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের তাঁদের শিল্প বাঁচাতে গ্যাস খাতে বিপুল চুরি বন্ধের প্রসঙ্গও তোলা প্রয়োজন। গত দুই দশকে জ্বালানি খাতে সরকারের যে ভর্তুকিনীতি, তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে শিল্প খাত। বিশ্ববাজারের থেকে অনেক কম মূল্যে গ্যাস পাওয়ায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা গত কয়েক দশকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটা বড় সুবিধা পেয়েছেন। বাসাবাড়ি থেকে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে দিতে গেলে ঘরে ঘরে যে অসন্তোষ তৈরি হবে, তার অভিঘাত রাজনৈতিক বিপ্লবের চেয়ে কম বড় নয়। ব্যবসায়ীরা যতই বলুন, সরকার এখন সে পথে যাবে না। কিন্তু বাসাবাড়িতে রান্নার জন্য ব্যবহৃত গ্যাসে যে অসমতার সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুতের মতো গ্যাসেও কেন মিটার ব্যবহার করা হয় না? যিনি যতটুকু গ্যাস পোড়াবেন, তার চেয়ে বেশি অথবা কম বিল কেন তিনি শোধ করবেন? সবার আগে চাই, গ্যাস খাতে সিস্টেম লসের নামে বিপুল পরিমাণ চুরি বন্ধ করা।